রোজা কবুলের জন্য যা করতে হবে

মাওলানা মুনীরুল ইসলাম : রোজা এমন এক ইবাদত, যা রোজাদারকে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ প্রভৃতি রিপু থেকে রক্ষা করে। রোজা একজন মানুষকে দান করে ধর্মীয় মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা, অন্তরের পবিত্রতা ও চিন্তাধারার বিশুদ্ধতা। রোজা কবুল হওয়ার জন্য কিছু শর্ত রয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমাদের যা নিষেধ করা হয়েছে তার মধ্যে যা গুরুতর, তা থেকে বিরত থাকলে তোমাদের লঘুতর পাপগুলো ক্ষমা করে দেব এবং তোমাদের সম্মানজনক স্থানে প্রবেশ করাব।’ (সূরা নিসা : ৩১)।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ও সওয়াবের নিয়তে রমজানে রোজা রাখবে তার আগের সব গোনাহ মাফ করে দেয়া হবে। যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ও সওয়াবের নিয়তে রমজানে রাতে ইবাদত করবে তার আগের সব গোনাহ মাফ করে দেয়া হবে। যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ও সওয়াবের নিয়তে কদরের রাতে ইবাদত করে কাটাবে তার আগের সব গোনাহ মাফ করে দেয়া হবে।’ (বোখারি ও মুসলিম)।
উপর্যুক্ত আয়াত ও হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হলো, আল্লাহর পক্ষ থেকে যে ক্ষমার ওয়াদা করা হয়েছে, তা তিনটি শর্ত সাপেক্ষে ১. রমজানের রোজা পালন করতে হবে ঈমানের সঙ্গে। অর্থাৎ আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) এর প্রতি ঈমান এবং রোজা একটি ফরজ ইবাদত এর বিশ্বাস রাখা। রোজা পালনকারীকে আল্লাহ যেসব পুরস্কার দেবেন এর প্রতি বিশ্বাস রাখা। ২. রোজা পালন করতে হবে সওয়াবের নিয়তে। অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ থেকে সওয়াব ও পুরস্কারের আশা করা, আল্লাহর রেজামন্দির জন্যই রোজা পালন করা এবং রোজাকে বোঝা মনে না করা। ৩. কবিরা গোনাহ থেকে দূরে থাকতে হবে। কবিরা গোনাহ ওইসব পাপকে বলা হয় যেগুলোর ব্যাপারে ইহকালীন শাস্তির বিধান দেয়া হয়েছে, পরকালে শাস্তির ঘোষণা রয়েছে অথবা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের পক্ষ থেকে লানত বা ক্রোধের ঘোষণা রয়েছে। যেমন শিরক করা, সুদ খাওয়া, এতিমের সম্পদ আত্মসাৎ করা, ব্যভিচার করা, জাদুটোনা করা, অন্যায় হত্যা করা, মা-বাবার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া, মিথ্যা মামলা করা, মাদক সেবন, ধোঁকাবাজি করা, মিথ্যা শপথ করা, অপবাদ দেয়া, গিবত বা পরনিন্দা করা, চোগলখোরি করা, সত্য গোপন করা ইত্যাদি।
রোজার ফজিলত ও সওয়াব অর্জনের জন্য শর্ত হলো ১. রোজা একমাত্র আল্লাহর জন্য পালন করতে হবে। লোকদেখানো বা মানুষের প্রশংসা অর্জন কিংবা স্বাস্থ্যের উন্নতির নিয়তে রোজা পালন করা যাবে না। ২. রোজা পালনের ক্ষেত্রে আল্লাহর রাসুল (সা.) এর সুন্নত অনুসরণ করতে হবে। সাহরি, ইফতার, তারাবিসহ যাবতীয় বিষয় রাসুলের সুন্নত অনুযায়ী আদায় করতে হবে। ৩. শুধু খাওয়া-দাওয়া ও যৌনাচার থেকে বিরত থাকলে যথেষ্ট হবে না। মিথ্যা, পরনিন্দা, অশ্লীলতা, ধোঁকাবাজি, ঝগড়া-বিবাদসহ সব ধরনের অবৈধ কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। মুখ যেমন খাবার থেকে বিরত থাকে, তেমনিভাবে চোখ বিরত থাকবে অন্যায় দৃষ্টি থেকে, কান বিরত থাকবে অনর্থক কথা ও গান-বাজনা শোনা থেকে, হাত বিরত থাকবে অবৈধ জিনিস ধরা থেকে, পা বিরত থাকবে অন্যায়-অসৎ পথে চলা থেকে, মস্তিষ্ক বিরত থাকবে খারাপ কল্পনা-জল্পনা থেকে। মোটকথা আমাদের আপাদমস্তককে পাপের কাজ থেকে বিরত রাখতে হবে।
রোজা পালনের মহান উদ্দেশ্য হলো, রোজা পালনকারী শরিয়তের দৃষ্টিতে সব ধরনের অন্যায় ও গর্হিত আচার-আচরণ থেকে নিজেকে হেফাজত করবে। তাই রোজা হলো সব ভালো বিষয় অর্জন ও অন্যায়-গর্হিত কাজ এবং কথা বর্জন অনুশীলনের একটি বিদ্যালয়। তাই তো রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে মিথ্যা কথা ও কাজ এবং মূর্খতা পরিত্যাগ করতে পারল না তার পানাহার বর্জনে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ (বোখারি)।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘অনেক রোজাদার ব্যক্তি এমন রয়েছেন, যাদের রোজার বিনিময়ে অনাহারে থাকা ব্যতীত আর কিছুই লাভ হয় না। আবার অনেক রাত জাগরণকারী এমন রয়েছেন, যাদের রাত জাগার কষ্ট ছাড়া আর কিছুই লাভ হয় না।’ (মুসনাদে আহমদ, ইবনে মাজাহ)।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘রোজা হলো ঢালস্বরূপ। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে রোজা পালন করবে সে যেন অশ্লীল আচরণ ও শোরগোল থেকে বিরত থাকে। যদি তার সঙ্গে কেউ ঝগড়া-বিবাদ কিংবা মারামারিতে লিপ্ত হতে চায়, তবে তাকে বলে দেবে আমি রোজাদার।’ (মুসলিম)।
পবিত্র কোরআন-হাদিসে বর্ণিত শর্তাবলী পালনের মাধ্যমে রোজা রাখলেই আমাদের রোজা কবুল হওয়ার এবং সওয়াব ও ফজিলত লাভের আশা করা যায়।
রোজা এমন এক ইবাদত, যাতে লোক দেখানোর মনোভাব সৃষ্টি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকে না। রোজার প্রতিদান স্বয়ং আল্লাহতায়ালাই দেবেন। এ সম্পর্কে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘রোজা আমার জন্য, আমি নিজেই এর প্রতিদান দেব। যে আমার (সন্তুষ্টির) জন্য তার কুপ্রবৃত্তি এবং খাদ্য ও পানীয় ত্যাগ করে।’ (বোখারি : ৭৪৯২)।